আগুন মমির গল্প: মৃত্যুর আগেই শুরু হতো যে প্রক্রিয়া

মমি! শুনলেই মনে হয় বিশাল পিরামিড, অভ্যন্তরে গোপন প্রকোষ্ঠে কারুকার্যময় কফিন, আর তাতে শায়িত কাপড়ে প্যাঁচানো মৃতদেহ। মমি মিশরীয় সভ্যতার কথাই তাই সর্বাগ্রে মনে হয়। তবে তারাই কিন্তু প্রথম নয়, তাদের আগে এবং পরে অনেকেই এই প্রক্রিয়ায় মৃতদের সংরক্ষণ করেছে। আগুন মমি (Fire mummy) তারই উদাহরণ। ধোঁয়া দিয়ে শরীর শুকিয়ে মমিকরণের এই প্রক্রিয়ার প্রচলন ছিল আমাদের এশিয়া মহাদেশেই, ফিলিপাইনে।

উত্তর ফিলিপাইনের বেঙ্গুত (Benguet) প্রদেশের পাহাড়ি এক অঞ্চল কাবাইয়ান (Kabayan)। এখানে বাস করে ইবালোই (Ibaloi ) উপজাতি। টিম্বাক (Timbac) পর্বতের পাদদেশে ছোট ছোট গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে তারা। এই পাহাড়ের গুহায় পাওয়া যায় আগুন মমির দেখা। ইবালোইদের পূর্বপুরুষেরা মৃতদের মমি করে রেখে আসতেন টিম্বাক, বাঙ্গাও, টেনোগচোল, নাপাই, ওপডাস এরকম আরো নানা গুহায়। এজন্য এই মমি ইবালোই মমি বা কাবাইয়ান মমি নামেও পরিচিত। 

ইবালোই গোত্র; Image Source: puertoparrot.com

ঠিক কবে থেকে আরম্ভ হয় এই পদ্ধতি? এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা মনে করেন এর সূচনা ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে মমিকরণ শুরু হয়েছিল তারও অন্তত হাজার বছর আগে। সূচনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সমাপ্তি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ১৫০০ শতকে স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফার্দিন্যান্দ ম্যাজেলান (Ferdinand Magellan) ফিলিপাইনে উপনিবেশ স্থাপন করেন। খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের সাথে সাথে হারিয়ে যেতে থাকে স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এই ধারায় বিলুপ্ত হয়ে যায় মৃতদেহ সৎকারের এই প্রক্রিয়া।

ফার্দিন্যান্দ ম্যাজেলান; Image Source: historyextra.com

ইবালোইরা ঠিক কীভাবে মমি করতো সেটা নিয়ে খুব বেশি লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসা গল্প থেকে বেশ ভালো তথ্য পাওয়া যায়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও  জানা গেছে অনেক কিছু। 

সব সুতো জোড়া দিয়ে জানা যায় মমিকরণের শুরুটা হতো ব্যক্তি জীবিত থাকাকালেই। মুমূর্ষুকে পান করতে দেয়া হতো লবণাক্ত একরকম পানীয়। নোনা পানি শরীরকে পানিশূন্য করে দেয়, সেটা জানা ছিল স্থানীয়দের। তারা মনে করতো মৃত্যুর আগে এই পানীয় খাওয়ালে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তবে আধুনিক বিজ্ঞানের মতে মমি তৈরির পেছনে এই প্রক্রিয়ার অবদান ছিল না বললেই চলে।

মূল কাজ শুরু হতো ব্যক্তি মারা যাবার পর। সব মিলিয়ে সপ্তাহখানেক থেকে মাসও লাগতে পারত। প্রাথমিক ধাপে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল দেয়া হত মৃতদেহ। এরপর তাকে ঢেকে দেয়া হত কোলেবাও (kolebao/pinagpagan) নামে বিশেষ ধরনে র কম্বলে। মাথায় পড়ানো হতো সিনালিবুবো (sinalibubo) নামে একরকম স্কার্ফ। মৃতকে বসানো হতো মৃতদের চেয়ার/সাঙ্গাচিলে (sangachil)। কম্বল দিয়ে বাঁধা থাকত তার দেহ, আর স্কার্ফ দিয়ে সোজা করা থাকত মাথা।

পরবর্তী ধাপ ছিল ধোঁয়া দিয়ে মৃতদেহ শুকিয়ে ফেলা। এজন্য ছোট করে আগুন জ্বালিয়ে তার নিচে রাখা হতো চেয়ার। তবে সরাসরি মৃত ব্যক্তিকে আগুনের সংস্পর্শে আনা হতো না কখনোই। তাপে শরীরের সমস্ত পানি ধীরে ধীরে বের হয়ে যেতো, সেটা সংরক্ষণ করা হতো বোতলে। পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে চেয়ার থেকে মৃতদেহ নামিয়ে আনত ইবালোইরা।

এবার আসতো শেষ ধাপের কাজ। কুঁচকে যাওয়া দেহ সূর্যের আলোতে রেখে দুদুয়ান (duduan) অনুষ্ঠান পালন করতো আত্মীয় ও সমাজের বয়োজ্যোষ্ঠরা। উদ্দেশ্য চামড়ার ওপরের অংশ ছাড়িয়ে নেয়া। স্থানীয় লতাপাতা আর শেকড়-বাকড় দিয়ে তৈরি বিশেষ ঔষধ শরীরে লাগিয়ে জ্বালানো হতো তামাক। এমন ব্যবস্থা করা হতো যাতে এই ধোঁয়া মৃতের নাকমুখ দিয়ে প্রবেশ করে। ইবালোইরা মনে করতো এর ফলে শরীরের ভেতর যদি আর কোনো পানি থেকেও থাকে সেটা শুকিয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য, বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বও ভুল বলে জানিয়েছেন।     

কাজ শেষ! এবার মৃত ব্যক্তি প্রস্তুত শেষবিদায় নেবার জন্য। মমিকে কোলেবাও দিয়ে কয়েকস্তরে ঢেকে কাঠের কফিনে মায়ের পেটে শিশু যেভাবে থাকে অনেকটা সেভাবে রেখে দিত সমাজের লোকেরা। নানা আচার পালন করতে করতে বয়ে নিয়ে যেত পাহাড়ি গুহায়। সেখানে তাকে রেখে দিয়ে তবেই সমাপ্ত হতো শেষকৃত্য।

কাঠের বাক্সে ভরে মমিকে রেখে আসা হতো পাহাড়ি গুহায়; Image Source: medium.com

ইবালোইদের বিশ্বাস অনুযায়ী আগুন মমিকে যেই গুহায় রাখা হয়েছে সেখান থেকে কখনোই বের করা যাবে না, তাহলে কষ্ট পাবে তাদের আত্মা। তেমন হলে নেমে আসবে অভিশাপ, দেখা দেবে নানা দুর্যোগ। গুহার ভেতরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অবশ্য নেয়া যাবে।

ইবালোইদের বাস ফিলিপাইনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাদের সমাধি গুহার অবস্থানও দুর্গম এলাকায়। সেখানে যেতে গাড়ি চালাতে হবে পাঁচ ঘন্টা। এরপর শুরু হবে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে ওঠা। আরো প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর দেখা পাওয়া যাবে এসব গুহার। নিরাপত্তার জন্য সরকার এগুলো বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। এতকিছুর পরেও ঠেকানো যায়নি চুরি।

চুরি হওয়া সবচেয়ে বিখ্যাত মমির ঘটনা সেই ১৯১৯ সালের। গবেষকরা তার নাম উদ্ধার করতে পেরেছিলেন- আপো আন্নু (Apo Annu)। সারা গায়ে বাহারি ট্যাটু করা এই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছরেরও বেশি আগে। সম্ভবত ইবালোইদের সর্বশেষ মমিগুলোর একটি এই আপো আন্নু। তার সমাধির থেকে জানা গেছে- নেতাগোছের কেউ ছিলেন তিনি, শিকারী হিসেবেও নামকরা। ইবালোইদের কাছে তিনি আধা-দেবতা আধা-মানুষ। তাই তার মমি চুরির পর যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসেছিল সবই তারা চাপিয়ে দেয় অভিশাপের ওপর। 

বিখ্যাত এই মমি খুঁজে বের করতে হন্যে হয়ে মাঠে নেমেছিলেন আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ। জানা যায়- ফিলিপিনো এক পাদ্রি সমাধি গুহা থেকে সরিয়ে নিয়ে যান আপো আন্নুকে। এরপর তার ঠাঁই হয় সার্কাসের প্রদর্শনিতে। বেশ কয়েক হাত ঘুরে এক সংগ্রাহক কিনে নেন এই মমি। ১৯৮৪ সালে সেটা পাঠিয়ে দেন ফিলিপাইনের জাতীয় জাদুঘরে। কর্তৃপক্ষ দ্রুত সরকারকে জানায়। তারা ইবালোই নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে আপো আন্নুকে পাঠিয়ে দেন তার লোকেদের কাছে। নানা রীতিনীতি পালন শেষে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় সমাধি গুহায়। সরকার এবার সেখানে লাগিয়ে দেয় লোহার গেট।

গুহামুখে এখন লোহার বেড়া আর গেট দেয়া হয়েছে; Image Source: Image Source: medium.com

২০০০ সালের দিকে বেশ কয়েকটি আগুন মমি চুরি হয়ে যায়। পরে ইউরোপের বিভিন্ন সংগ্রাহক মোটা অঙ্কে কিনে নেন এগুলো। ২০০৪ সালে আটটি মমি ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে এখনো বেশ কয়েকটি আগুন মমি রয়ে গেছে সংগ্রাহকদের কাছে।

আগুন আর ধোঁয়া ব্যবহার করে মমি করার পদ্ধতি কিন্তু ইবালোইদের একার নয়। পাপুয়া নিউ গিনির বেশ কিছু উপজাতির মধ্যেও এর প্রচলন ছিল। তবে ফিলিপাইনের আগুন মমিই বেশি পরিচিত। সব মিলিয়ে ৫০-৮০টি এমন মমি পাওয়া গেছে। তবে অনেকগুলোর অবস্থান গোপন করে রাখা হয়েছে চুরি ঠেকাতে।

ইবালোইরা আজও তাদের মমি করা পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাদের জন্য উৎসর্গ করে খাদ্য আর পানীয়। সমাধি গুহায় ঢুকে গবেষণা করতে হলে তাদের নেতাদের অনুমতি লাগে। কাজ করতে হয় গুহার ভেতরে, এবং সেখানে স্থানীয় একজন লোক সবসময় উপস্থিত থাকে। তার কাজ মমিকে বুঝিয়ে বলা- কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top