স্পিনের বিপক্ষে সাফল্য পাবে বাজবল?

হেড কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের খেলার ধরনকে খোলনলচে বদলে দিয়েছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ধীরলয়ের অনুমিত ক্রিকেটের বদলে দলটি এখন খেলছে মনকাড়া আক্রমণাত্মক ক্রিকেট, ড্রয়ের দিকে এগোতে থাকা একঘেয়ে টেস্টগুলোও এখন পাচ্ছে নতুন প্রাণ। শতভাগ সফলতা না পেলেও মোটাদাগে ‘বাজবল’কে ব্যর্থ বলার সুযোগ নেই।

তবে ম্যাককালাম-স্টোকসের দলের পরীক্ষা এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, আগামী বছরের শুরুতে বাজবলকে মুখোমুখি হতে হবে ভারতের, আর সেটাও ভারতের মাটিতে। পাঁচ ম্যাচের এই লম্বা টেস্ট সিরিজে নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় স্পিনের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে ইংল্যান্ডকে, তাতে থ্রি লায়ন্সের সাফল্যের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেছে উইজডেন

স্টোকস-ম্যাককালামের বাজবল কি সাফল্য পাবে স্পিনের বিপক্ষে? Image Source: Getty Images

এমনিতে টেস্ট ফরম্যাটে নিজেদের মাটিতে ভারত অপ্রতিরোধ্য। ঘরের মাঠে সর্বশেষ ৪৮ টেস্টের মধ্যে মাত্র ৩টি ক্ষেত্রে পরাজয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে ভারতীয়রা। কোনো সফরকারী দলকে একটি সিরিজে ভারতকে একাধিকবার পরাজয়ের স্বাদ দিয়েছে, এই ঘটনা সর্বশেষ ঘটেছে ২০১২ সালে, এবং সেক্ষেত্রেও সফরকারী দলটার নাম ছিল ইংল্যান্ড। ঐ সিরিজেই প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্যাপ পরেছিলেন জো রুট আর রবীন্দ্র জাদেজা, বিরাট কোহলি পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।

ব্রেন্ডন ম্যাককালামের অধীনে সর্বশেষ চৌদ্দ মাসে বেশ ভালো পরিমাণ সাফল্যই পেয়েছে ইংল্যান্ড, তবে ২০১২ এর ঐ সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হলে বেশ কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তাদের। স্পিন আক্রমণের নেতৃত্ব কে দেবেন, পেসাররা পর্যাপ্ত সাফল্য পাবেন কি না, আর সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় স্পিনারদের, বিশেষত রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে কীভাবে মোকাবেলা করবেন, এই প্রশ্নগুলোই নিশ্চয়ই চিন্তার ভাঁজ বাড়াচ্ছে ব্রেন্ডন ‘বাজ’ ম্যাককালামের কপালে।

স্পিন আক্রমণ সামলাবেন কারা?

টেস্ট ক্রিকেটকে আগেই বিদায় বলে দেওয়া মঈন আলীকে ‘এসওএস’ দিয়ে অ্যাশেজের আগে ফিরিয়ে এনেছিলেন অধিনায়ক বেন স্টোকস। তবে এই অলরাউন্ডার নিশ্চিত করেছেন, ভারত সফরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। সেক্ষেত্রে স্পিন আক্রমণের নেতৃত্বটা হয়তো জ্যাক লিচের কাঁধেই থাকবে। কিন্তু একজন স্পিনার নিয়ে নিশ্চয়ই পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে যাবে না ইংল্যান্ড দল, সেক্ষেত্রে বাড়তি স্পিনার হিসেবে হয়তো রেহান আহমেদকে দেখা যেতে পারে।

রেহান আহমেদ; Image Source: Getty Images

এই দু’জনের বাইরেও, ইংরেজদের হাতে রয়েছে আরো কিছু বিকল্প। অলরাউন্ডার উইল জ্যাকস ও লিয়াম ডসনের ওপরও থাকতে পারে স্পিন আক্রমণ সামলানোর দায়িত্ব। যদিও সর্বশেষ মৌসুমে সারের হয়ে খুব বেশি হাত ঘোরাননি জ্যাকস, আর পাকিস্তান সফরে একটি ইনিংসে ছয় উইকেট পেলেও তার ওপরই স্পিনের পুরো দায়িত্ব দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই কয়েকবার ভাববেন স্টোকস-ম্যাককালাম। হয়তো ব্যাটিং-অলরাউন্ডার হিসেবেই দলে ঢুকবেন তিনি, যিনি কাজ চালানোর মতো কিছু ওভার হাত ঘোরাতে পারবেন; যদিও সেক্ষেত্রে বেঞ্চ গরম করতে হবে টপ বা মিডল অর্ডারের কোনো নিয়মিত ব্যাটসম্যানকে। ওদিকে বোলিং-অলরাউন্ডার হিসেবে কিছুটা নামডাক রয়েছে লিয়াম ডসনের, কাউন্টির সর্বশেষ মৌসুমে ১৮.৫০ গড়ে ২০ উইকেট নিয়ে ভারত সফরের ‘প্রার্থী’দের তালিকায় রেখেছেন নিজেকেও। সাসেক্সের অফ স্পিনার জ্যাক কারসনকেও হয়তো ভবিষ্যতের জন্য ভাবতে পারেন নির্বাচকরা, তবে বল হাতে পঞ্চাশোর্ধ্ব গড়টা এই বাইশ-বছর বয়সীর বিপক্ষেই যাচ্ছে আপাতত।

কে হবেন পঞ্চম বোলার?

সাধারণভাবে এই জায়গাটা নেওয়ার কথা অধিনায়ক বেন স্টোকসেরই। যদিও ইদানিং খুব বেশি বোলিং করেন না এই অলরাউন্ডার, সর্বশেষ অ্যাশেজের পাঁচ ম্যাচ মিলিয়ে তিনি হাত ঘুরিয়েছিলেন মোট ২৯ ওভার। এই বোলিং করার প্রভাব পড়েছিল তার ব্যাটিংয়ে; বেশ কয়েকবার হাঁটুর ব্যথায় ভুগতে দেখা গেছে ইংরেজ অধিনায়ককে। তাই যদি বেন স্টোকস নিজেকে বোলিং থেকে সরিয়ে রাখেন, ওদিকে মঈন আলীও না ফেরেন দলে, সেক্ষেত্রে পঞ্চম বোলার কে হবেন, সেটা নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টকে বাড়তি চিন্তা করতেই হবে।

ভারতের মাটিতে ভারতের ব্যাটিং লাইনের বিরুদ্ধে কোনো কোনো ইনিংসে দীর্ঘ সময় ধরে বল করার প্রয়োজন হতেই পারে, সেক্ষেত্রে অন্তত পাঁচজন পুরোদস্তর বোলার নিয়ে মাঠে না নামলে টেস্ট জয়ের আশা করা কঠিন। সেক্ষেত্রে স্টোকস নিজে ব্যাটিং অর্ডারের তিনে উঠে এসে পাঁচে আরেকজন ব্যাটসম্যানকে খেলাতে পারেন, অ্যাশেজের ওভাল টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে যেমনটা দেখা গিয়েছিল। এই ব্যবস্থায় পাঁচজন বোলারকে সহজেই খেলাতে পারবে ইংল্যান্ড।

পঞ্চম বোলার হবেন বেন স্টোকস; Image Source: Getty Images

তবে এক্ষেত্রেও একটা সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে সাত নম্বরে খেলবেন রেহান আহমেদ বা ক্রিস ওকস, দ্বিতীয়জনের খেলার সম্ভাবনাই বেশি। রেহান আহমেদের তুলনায় ওকসের ব্যাটিংটাই ভালো, টেস্ট সেঞ্চুরি আছে, হেডিংলিতে জয়সূচক রানগুলোও এসেছে তার ব্যাট থেকে। কিন্তু তবুও দলে ওকসের মূল দায়িত্বটা থাকে বোলার হিসেবে, আর ভারতের মাটিতে তার বোলিং গড় ৮১.৩৩। অ্যাশেজের সিরিজসেরা দু’জনের একজন হলেও ভারত সিরিজের মূল একাদশে তার জায়গাকে নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে না। আবার ভারতের মাটিতে যেহেতু খেলা, একাদশে তো অন্তত দুজন স্পিনার রাখতেই হবে, এবং সেই দুটো নাম রেহান আহমেদ ও জ্যাক লিচ হওয়ার সম্ভাবনাই সর্বাধিক। সেক্ষেত্রে একাদশের বাকি জায়গাগুলো পূরণ করবেন ক্রিস ওকস, জেমস অ্যান্ডারসন, ওলি রবিনসন, জশ টং, লিয়াম ডসন আর উইল জ্যাকসের মধ্যে যেকোন তিনজন। উইল জ্যাকস বা লিয়াম ডসন সাতেও ব্যাট করতে পারবেন, ডসনের বোলিংটাও বেশ কার্যকর হওয়ার কথা।

স্যাম কারেন হতে পারেন তুরুপের তাস; Image Source: Getty Images

তবে শেষ পর্যন্ত দু’জন স্পিনার নিয়েই যদি ইংল্যান্ড মাঠে নামে, সেক্ষেত্রে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারেন স্যাম কারেন। সাতে ব্যাটিং করতে পারেন, বাঁহাতি পেসার হিসেবেও মন্দ নন, দু’য়ে মিলে ভারতের মাটিতে কার্যকর হতেই পারেন তিনি।

ওলি পোপের জায়গা কোথায়?

গত বছরে ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বরে পদোন্নতির পর থেকে ওই জায়গায় নিজেকে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন ওলি পোপ। গত এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের তিন নম্বর জায়গায় দিয়েছিলেন ভরসার আশ্বাস। অ্যাশেজের লর্ডস টেস্টে সেই পোপ যখন কাঁধের ইনজুরিতে পড়লেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল টিম ম্যানেজমেন্টের কপালে, যদিও এর আগের দুই টেস্টেও তেমন হাসেনি তার ব্যাট।

টপ অর্ডারে ফিরবেন ওলি পোপ? Image Source: Getty Images

এর আগে লর্ডসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন পোপ। তবে ফ্ল্যাট পিচে অনভিজ্ঞ বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ঐ দ্বিশতক নিয়ে পোপ নিজেও কতটা গর্ব করবে, সেটাও ভাবনার বিষয়।

এর আগে যেমনটা বলা হলো, বেন স্টোকসকে যদি তিন নম্বরে খেলাতেই হয়, তাহলে হয়তো জায়গাটা ছাড়তে হবে ওলি পোপকে; আর তাতেই সম্ভবত সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দলটা পাবে ইংল্যান্ড। তবে ওলি পোপকে নিয়েও ইংল্যান্ড ভারসাম্যপূর্ণ দল গঠন করতে পারে, সেক্ষেত্রে মিডল অর্ডারে নেমে যেতে হবে স্টোকসকে, খেলতে হবে পঞ্চম বোলার হিসেবে। স্টোকসের হাঁটু তাতে সায় দিলে হয়!

দলে ফিরবেন বেন ফোকস?

আপনি বলতেই পারেন, উইকেটরক্ষক ওলি পোপই যেখানে দলে সুযোগ পাচ্ছেন না, সেখানে আরেক উইকেটরক্ষক বেন ফোকস কীভাবে জায়গা পাবেন! এক্ষেত্রে বেন ফোকসের জন্য সহায় হয়ে আসতে পারে দস্তানা হাতে জনি বেয়ারস্টোর চলমান খারাপ ফর্ম। অ্যাশেজেও খুব ভালো ফর্মে দেখা যায়নি উইকেটরক্ষক বেয়ারস্টোকে। পাশাপাশি, ইংল্যান্ডের চেয়ে এশিয়ায় উইকেটরক্ষণের কাজটা আরো বেশি কঠিন। স্ট্যাম্পের কাছাকাছি দাঁড়ানো, দ্রুতগতির স্ট্যাম্পিং, স্পিনের বিরুদ্ধে আসা ক্যাচের সুযোগ, সবই একজন উইকেটরক্ষকের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। বেয়ারস্টোই হয়তো প্রথম পছন্দের কিপার থাকবেন, তবে তার বাজে ফর্ম চলতে থাকলে হয়তো ফোকসের সুযোগ আসতেও পারে। পাশাপাশি ভারতের মাটিতে বেয়ারস্টোর গড় ২৯.৯২, অপরদিকে এশিয়াতে ব্যাট হাতে নিজের কার্যকারিতা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন বেন ফোকস।

বেন ফোকসের জন্য কাজটা অনেক কঠিন; Image Source: Getty Images

ব্যাট এবং গ্লাভস, দুটো ক্ষেত্রেই বেয়ারস্টো খুব বাজে ফর্মে না চলে গেলে বেন ফোকসের সুযোগ তেমন একটা নেই। বিকল্প হিসেবে ওলি পোপ আর হ্যারি ব্রুকের মতো ব্যাটসম্যানও থাকায়, ফোকসের কাজটা আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

অ্যান্ডারসনের শেষ ভারত সফর?

ক্যারিয়ার শেষ করার আগে অন্তত আরেকবার ভারত সফর করার ইচ্ছা অনেকবারই পোষণ করেছেন জেমস অ্যান্ডারসন, যদিও তাকে দলে নেওয়ার শেষ বলটা ঠেলে দিয়েছেন নির্বাচকদের কোর্টেই। সর্বশেষ অ্যাশেজটা খুব ভালো যায়নি, তবুও অধিনায়ক বেন স্টোকসও বারবার তার পেস আক্রমণের নেতা হিসেবে জেমস অ্যান্ডারসনকেই চেয়েছেন। আর সে কারণেই দলে জায়গাটা মোটামুটি নিশ্চিতই থাকছে অ্যান্ডারসনের, তবে সব ম্যাচে একাদশে সুযোগ পাওয়ার নিশ্চয়তা হয়তো দেওয়া সম্ভব নয়।

অ্যান্ডারসনের শেষ ভারত সফর? Image Source: BCCI

এশিয়াতে অবশ্য অ্যান্ডারসনের রেকর্ডটা দারুণ। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের ঐ সিরিজ জয়ের মূল নায়ক ছিলেন তিনিই। ২০২১ সালের সিরিজেও বল হাতে চমৎকার পারফর্ম করেছিলেন অ্যান্ডারসন, ১৫.৮৭ ছিল তার গড়।

সব মিলিয়ে পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের বাজবল ক্রিকেট যতটা সফল, স্পিনের বিপক্ষে ততটা সফল হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top